You are currently viewing সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি আলোচনা করো। Cause of decline of sultanate empire

সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি আলোচনা করো। Cause of decline of sultanate empire

সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ ভারতবর্ষের মধ্যযুগের ইতিহাসের এক অতি চর্চিত বিষয়। কোন সাম্রাজ্যের উত্থান যেমন আছে তেমনি আছে তার পতনের কাহিনী। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সুলতানি সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও এর বিপরীত ঘটনা ঘটেনি। অর্থাৎ সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি বিশেষভাবে ঐতিহাসিকদের নজর কারে। যেভাবে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ঠিক সেভাবেই দীর্ঘ পথ চলার পর এই সাম্রাজ্য পতনের দিকে ধাবিত হয়। সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ আলোচনা করলে দেখা যায় একাধিক কারণে এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে।

ভূমিকা ঃ- ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে প্রায় ৩০০ বছরের কাছাকাছি সময় সাফল্যের সঙ্গে এই সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব টিকে থাকে। ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে ফিরোজ শাহ তুঘলকের মৃত্যুর পর থেকেই সুলতানি সাম্রাজ্য ক্রমে পতনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদি মোগল বীর বাবরের কাছে পরাজিত হলে দীর্ঘ ৩০০ বছরের সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

[1] সাম্রাজ্যের বিশালতা

সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের একটি প্রধান কারণ ছিল সাম্রাজ্যের বিশালতা। মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমলে দাক্ষিণাত্য সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে এলে সাম্রাজ্যের আয়তন বহুদূর বিস্তৃত হয়। ফলে দিল্লি থেকে দূরবর্তী স্থানগুলি ভালোভাবে শাসন করা সম্ভব হত না। এই সুযোগে বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা ঘোষণার প্রবণতা দেখা দেয়।

[2] সামরিক দুর্বলতা

শক্তিশালী ও সুদক্ষ সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করে সুলতানি শাসকরা সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন ও বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করে সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষা করেছেন। কিন্তু আলাউদ্দিনের পরবর্তীকাল থেকে সুলতানি সেনাদলের শক্তি ক্রমে দুর্বল হতে থাকে। ফলে সাম্রাজ্যের ক্ষাত্রশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।

[3] শাসকদের অযোগ্যতা

শাসকের ব্যক্তিগত দক্ষতা ও যোগ্যতার ওপর স্বৈরশাসনের অস্তিত্ব নির্ভর করে। সুলতানি সাম্রাজ্যে ইলতুৎমিস, বলবন বা আলাউদ্দিন খলজি নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে সাম্রাজ্যের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। সুলতানি সাম্রাজ্যের শেষ যোগ্য সম্রাট ছিলেন ফিরোজ শাহ তুঘলক। ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর আর কোনো সুদক্ষ ও যোগ্য শাসক দিল্লির সুলতানি সিংহাসনে বসেননি। পরবর্তীকালের সম্রাটদের বিলাসিতা, দুর্বলতা, নীতিবোধহীনতা প্রভৃতির ফলে সুলতানি শাসন ক্রমশ ভাঙনের দিকে এগিয়ে যায়।

4] অভিজাতদের অবক্ষয়

সুলতানি শাসনব্যবস্থায় অভিজাতশ্রেণির বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাঁরা সুলতানি শাসনে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করত। কিন্তু পরবর্তীকালে এই অভিজাতরা বিলাসিতা ও নীতিহীনতায় ডুবে যায়। তারা ক্রমে দুর্নীতিপরায়ণ, ষড়যন্ত্রপরায়ণ ও ক্ষমতালোভী হয়ে ওঠে। ফিরোজ তুঘলক অভিজাতদের নানা দুর্নীতির কথা জানলেও ঝামেলা থেকে দূরে থাকার জন্য তিনি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকেন।

[5] জনসমর্থনের অভাব

সামরিক শক্তির ওপর ভিত্তি করে সুলতানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এই সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করেই সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব টিকেছিল। ফলে এর প্রতি জনগণের সমর্থন বা আনুগত্যের যথেষ্ট অভাব ছিল।

[6] ক্রীতদাস পোষণ

সুলতানি শাসনের প্রথমদিকে ক্রীতদাসরা শাসনকার্যে নানাভাবে সহায়তা করত। কুতুবউদ্দিন, ইলতুৎমিস বা বলবনের মতো দক্ষ শাসকরা ক্রীতদাসের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছিলেন। কিন্তু ফিরোজ তুঘলকের আমল থেকে ক্রীতদাস প্রথা সাম্রাজ্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফিরোজ ক্রীতদাসদের সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি করে তাদের ভরণপোষণে রাজকোশের প্রভূত অর্থ খরচ করে ফেলেন।

আরও পড় 1757 পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

[7] জায়গিরদারি প্রথার কুফল

ফিরোজ তুঘলক জায়গিরদারি প্রথার পুনঃপ্রবর্তন করলে এই প্রথার রন্দ্রে রস্ত্রে দুর্নীতি প্রবেশ করে। কিন্তু ফিরোজ তুঘলক সে বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকেন। পরবর্তীকালের সুলতানদের অবশ্য এই পরিস্থতি মোকাবিলা করার মতো যোগ্যতাই ছিল না। ফলে সাম্রাজ্যের সংহতি নষ্ট হয়।

[8] ধর্মনীতি

হিন্দুমন্দির ধ্বংস করা এবং তাদের মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা ছিল মুসলিম শাসকদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। অমুসলিম প্রজাদের ওপর ‘জিজিয়া’-সহ বিভিন্ন দমনমূলক কর আরোপ করা হয়। ফিরোজ তুঘলক সুলতানি সাম্রাজ্যকে একটি ‘ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রে’ পরিণত করেন। ফলে দেশের বিপুল সংখ্যক অমুসলিম প্রজা সুলতানি শাসনের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করত।

[9] তৈমুর লঙ-এর আক্রমণ

১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর লঙ-এর ভারত আক্রমণ সুলতানি সাম্রাজ্যে মৃত্যুদূতের মতো এসে উপস্থিত হয়। তৈমুরের আক্রমণ, হত্যাকান্ড, লুণ্ঠন প্রভৃতির ফলে ভারতের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি দারুণভাবে বিপন্ন হয়। শাসনব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়ে। এই সুযোগে দেশের বিভিন্ন পড়ে। আঞ্চলিক শক্তি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে দিল্লি সুলতানির আয়তন অতি ক্ষুদ্র সীমায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে।

[10] বাবরের আক্রমণ

তৈমুরের আক্রমণ একদিকে যেমন ভারতের প্রাণশক্তি নিঃশেষ করে, অন্যদিকে তেমনি অন্যান্য বিদেশি শক্তিগুলির ভারত-আক্রমণের পথ প্রশস্ত করে দেয়। এই পথ ধরেই মোগল বীর জহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবর ভারত আক্রমণ করেন। তিনি ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে ইব্রাহিম লোদিকে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত করে সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন ঘটান।

উপসংহার

  • ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে মোগল সম্রাট বাবর ভারতে সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন সম্পূর্ণ করেন। এই পতনের ধ্বংসস্তূপের ওপর বাবরের মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সঙ্গে ভারতের ইতিহাসের একটি নতুন যুগ ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়।

Leave a Reply